রকি

 



রকির চাহনিতে আজ কেমন এক উদাসীনতার ছাপ লক্ষ্য করছি । সে বেশ কয়েকবার বাথরুমের খোলা দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এবং কিছু যেন খুঁজে চলেছে । পর মুহূর্তেই তার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে আমার দিকে। সে কখনো বিছানায় উঠে বসছে এবং তার কিছুক্ষন পরেই দেয়ালের পাশে রাখা স্টাডি টেবিল এর তলায় মুখ লুকিয়ে ফেলছে। এরূপ চঞ্চল খুব কম দেখেছি রকি কে। ও কি ভয় পেয়েছে তবে? অবশ্য, ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
আমি, আমার ল্যাব্রাডর রকিকে নিয়ে দুদিন আগেই বেড়াতে এসেছি সমুদ্রের ধারে এই ছোট্ট শহরটিতে । অবশ্য জায়গাটিকে শহর বললে ভুল বলা হয়,আবার ঠিক গ্রাম ও বলা যায়না । এখনো নিরিবিলি থাকা কিছু জায়গার মধ্যে এটি অন্যতম । তবে গত তিন চার বছরে যে হারে দোকানপাটের সংখ্যা বেড়েছে, এখানকার প্রকৃতিও ঠিক ততটাই অসহায় বোধ করেছে হয়তো।
আমি পাহাড় এ যেতেই বেশি পছন্দ করি বরাবর। কিন্তু রকি কে নিয়ে কোথাও সেরকম যাওয়া হয়ে ওঠেনা। খোলা আকাশের নিচে বিচ এর ধার ঘেঁষে ছুটোছুটি করতে ভারী মজা পায় রকি । এই পেট -ফ্রেন্ডলি হোটেল টাও বেশ পেয়ে গেলাম। তবে চেঞ্জ এর জন্য আমাদের এই ভ্রমণ হঠাৎ বাধার সম্মুখীন হলো।
হোটেলে গতকাল রাতে হয়ে গেছে এক নৃশংস খুন। সকাল থেকেই লেগে রয়েছে স্থানীয় পুলিশ অফিসারদের আনাগোনা । চলছে প্রত্যেক রুমে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ। আমাদের ঘরে এখনো আসেননি অফিসাররা তবে তা যে হতে চলেছে শীঘ্রই সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যেই সব গেস্টদের শহর ছেড়ে বেরোতে নিষেধ করা হয়েছে। ঘরের এয়ার কন্ডিশনার কাজ না করাতে দরজাটা হালকা করে খুলে রেখে তটস্থ হয়ে বসে রয়েছি। মনের ভিতর এক অজানা ভয় কাজ করছে।
রকি কিছুটা শান্ত এখন। ঘরের এক কোণায় চুপ করে বসে রয়েছে । লাল ডিম্ লাইট এর আভা তার সাদা লোমের ওপর পড়েছে। কিন্তু তার দৃষ্টি এখনো এক রকম। আমার দিকে কয়েকবার তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে কি যেন ভাবছে সে। যেন অনেক কিছু বলতে চেয়েও পারছে না।
হঠাৎ,সিঁড়ি দিয়ে পায়ের শব্দ পেয়ে সোজা হয়ে বসলাম চেয়ারটায়। কান খাঁড়া করে শুনতে চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, এই দিকেই আসছে আওয়াজটা । মিনিট খানেকের মধ্যেই দরজার পাল্লা পুরো খুলে গেলো। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ অফিসার। আমার দিকে একবার তাকালেন তিনি তবে কিছু বললেন না। এর পর মেঝে তে রকি কে দেখতে পেয়ে তার মুখে এক রাশ বিরক্তি ফুটে উঠলো। কার দিকে যেন চিৎকার করে কুৎসিত গালাগাল দিয়ে বললেন
'এই কুকুরটা এখানে এলো কি করে, হ্যাঁ ? একটা কাজ বললে ঠিক মতো করতে পারো না, অকর্মার ঢেঁকি সব । ফর গড'স সেক, দিস ইস এ ক্রাইম সিন। মূর্খের দল কন্টামিনেট করেই ছাড়বে। ' বলে তিনি রকির দিকে এগিয়ে গিয়ে আবার তারস্বরে চিৎকার করলেন। রকি আমার দিকে এক পলকের জন্য ঘুরে তাকালো। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে ।
গতকালের ঘটনা। এয়ার কন্ডিশনার না চলা এবং কাঁচের জানলা না খুলতে পাড়ার দরুন অনিচ্ছা সত্ত্বেও দরজা খোলা রেখেই শুয়েছিলাম। মাঝরাতে রকির চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। এক ছায়ামূর্তিকে যেন চলে যেতে দেখলাম সিঁড়ির দিকে। রকি এক ছুটে তাড়া করল তাকে। আমি কিছু বুঝে ওঠবার আগেই দরজার আরেক পাশ থেকে বেরিয়ে এলো আমার খুব চেনা একটি মুখ ।
'আর কতদিন পালিয়ে বাঁচবে ? গ্যাং থেকে টাকা চুরি করার শাস্তি তুমিও জানো। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই আলো আঁধারিতে তার ঝকঝকে লম্বা ছুঁড়ির ফলা দেখে শিউরে উঠলাম।
রকি যখন ঘরে ফেরে তখন সব শেষ। সকালে বাথরুমের মেঝেতে আমার মৃতদেহ পাওয়া যায়। এর পর রকি যত বার দেখেছে আমার দিকে, তার দৃষ্টিতে সেই বিস্বাদ লক্ষ্য করেছি। যেন এক দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আজ থেকে সে খুব একা। আজ থেকে ওর কোনো নাম নেই। আর হয়তো কেউ ওকে রকি বলে ডাকবে না। হয়তো অন্য কোনো নামে সে সময়ের সাথে সারা দেবে।
নিজের উপর আরো ঘৃণা বেড়ে যাচ্ছে আমার। হয়তো এই আমার প্রাপ্য এক অবলা প্রাণীর ঘ্রাণশক্তি কে নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করার জন্য। রকি কি সব বুঝতো? আমার মৃত্যুর জন্য সে কি নিজেকে দায়ী করছে? হয়তো কখনো জানতে পারবো না।
সমুদ্রের ধার ঘেঁষে রকি কে হেটে যেতে দেখছি। সাদা ঢেউ এসে তার পা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বারবার। দূরে কিছু ছোট ছেলেরা বালির উপর ফুটবল খেলছে। তাদের দেখে হঠাৎ রকি উত্তেজিত হয়ে পরে। ঠিক আগের মতো, আজও সে পিছনে ফিরে দেখতে পায়ে আমাকে। তবে আজ তার চাহনি আমাকে সঙ্গী হতে ডাকে না। লেজ নেড়ে যেন চিরবিদায় জানায় রকি।
তারপর খোলা আকাশের নিচে বল টার দিকে ছুটে যায়।

Comments

Popular posts from this blog

Losing

Winter

19 : Elements of Liverpool's title-winning campaign